আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা (ইক্বরা) ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে সংগঠিত হয়েছিল। এটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ‘ইত্তেহাদুল কুররা’, অর্থাৎ বিশ্বের আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ ক্বারীদের সংগঠন। কার্যকরী সদস্যবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে ‘International Quran Recitation Association (IQRA)’ নামটিকে গ্রহণ করেছিলেন। ‘ইক্বরা’ গঠন করার পেছনে যাঁদের অবদান ছিল এবং ‘ইক্বরা’র প্রথম কমিটির সদস্যরা ছিলেন:-
১। ‘ইক্বরা’র প্রথম সভাপতি মনোনীত হয়েছিরেন মিসরের তৎকালীন শাইখুল কুররা শাইখ মাহমুদ খলীল আল হুসারী (রহ.)।
২। মহাসচিব হিসেবে ছিলেন পাকিস্তানের ক্বারী যাহের ক্বাসেমী (রহ.)।
‘ইক্বরা’র কার্যকরী সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন:-
৩। মিসরের বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী শাইখ আবদুল বাসিত মুহাম্মাদ আবদুস সামাদ (রহ.),
৪। তৎকালীন পাকিস্তানের, পরবর্তীতে বাংলাদেশের (ইমামুল কুররা) হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.),
৫। ইয়েমেনের শাইখ মুহাম্মাদ আলী শরফুদ্দীন (রহ.)
৬। পাকিস্তানের ক্বারী শাকের কাসেমী
৭। পাকিস্তানের মাওলানা আসিফ কাসেমী এবং
৮। পাকিস্তানের ক্বারী মুহাম্মাদ ইলিয়াস (রহঃ)
‘ইক্বরা’ আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন পরবর্তী বছর ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, পেশাওয়ার এবং পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার পল্টন ময়দান, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এবং সিলেটের আলীয়া মাদরাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত সম্মেলন উদ্বোধন করেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ মুসা এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান। উক্ত সম্মেলনে বিশ্বের ১৭টি দেশের বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী সাহেবগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তারা আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা ‘ইক্বরা’-এর আজীবন সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন-
মিসর: তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্বারী যাঁকে আধুনিক তিলাওয়াতের রূপকার বলা হয়, শাইখ মুস্তফা ইসমাঈল (রহ.)। আরো ছিলেন শাইখ মাহমুদ খলীল আল হুসারী (রহ.), শাইখ আবদুল বাসিত মুহাম্মাদ আবদুস সামাদ (রহ.), শাইখ ঈ’ত্বা সুলাইমান রিযক এবং শাইখ আহমাদ আদ্দিয়াসতী আবুল মা‘আতী (রহ.)।
পাকিস্তান: ক্বারী যাহের ক্বাসেমী (রহ.), ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.) [পরবর্তীতে বাংলাদেশ], ক্বারী শাকের কাসেমী, ক্বারী মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহ.), মাওলানা আসিফ কাসেমী এবং ক্বারী ওয়াহিদ জা’ফার কাসেমী।
লেবানন: শাইখ সালাহ উদ্দিন কাব্বারা (রহ.), ক্বারী মাহমুদ শামতলী (রহ.)।
ইয়েমেন: উস্তাদ ক্বারী আলী মুহাম্মাদ শরফুদ্দীন (রহ.)।
মালয়েশিয়া: ক্বারী হাসান আল আযহারী, ক্বারী ইসমাঈল বিন হাশিম।
ইন্দোনেশিয়া: ক্বারী বাসোরী আলউয়ী, ক্বারী আবদুল আযিয মুসলিম, ক্বারী ফুয়াদ যেইন, ক্বারী আবু বকর।
ইরান: ক্বারী ইবরাহীম আরেফী, ক্বারী মাহদী রুক‘আবী, ক্বারী মুহাম্মাদ রাব‘অী।
মরক্কো: ক্বারী আবদুল হামিদ হাসায়েয়ীন।
তুরস্ক: ক্বারী আবদুর রহমান গোর্সেস।
ইরাক: ক্বারী হাফিয সালাহ উদ্দিন, ক্বারী আব্দুর রহমান তৌফিক।
সৌদি আরব: ক্বারী মুহাম্মাাদ জামীল আ‘শী।
সুদান: ক্বারী আহমাদ ইসমাঈল আল বাইলী, ক্বারী সাইয়্যিদ উসমান মানসূর আল র্বারূদী।
নাইজেরিয়া: ক্বারী আলহাজ্জ ইয়াকুবু, ক্বারী আলহাজ্জ আরকাসু ওয়ো।
শ্রীলঙ্কা: ক্বারী এস.এম. বুহারী, ক্বারী মুহাম্মাদ যাকারিয়া।
থাইল্যান্ড: ক্বারী সাইয়্যিদ মাহমুদ।
ফিলিপাইন: ক্বারী সা‘আদুদ্দীন আই আলউয়ী এবং
সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া): ক্বারী রহমত উল্লাহ।
১৯৬৭ সালের ২য় আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনের পর কিছু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ‘ইক্বরা’র কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের ইন্তেকালের পর, আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা(ইক্বরা’র) কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।
মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.), যিনি ‘ইক্বরা’র একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং যিনি করাচি রেডিও ও পাকিস্তান টেলিভিশনের (পিটিভি) নিজস্ব ক্বারী ছিলেন। যিনি ১৯৬৬ সালে সংগঠিত ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এবং ১৯৭১ সালে সংগঠিত মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবকে পাকিস্তানে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িত থাকায় পাকিস্তান সরকার কর্তৃক করাচি রেডিও ও পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং গ্রপ্তারি পরোয়ানা জাড়ি করা হয়। মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ গ্রেপ্তারী পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পাকিস্তান থেকে সবকিছু ত্যাগ করে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.) কে বাংলাদেশের প্রধান ক্বারী হিসেবে নিযুক্ত করেন যার দায়িত্ব অর্পিত হয় বাংলাদেশ রেডিও ও টেলিভিশন এর প্রধান ক্বারী হিসেবে।
ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.) বাংলাদেশে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রমকে পুনরায় শুরু করার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। কিন্তু নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি দেশে সম্পদের স্বল্পতা এবং দেশজ উন্নয়নের কারণে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুরু করা যায়নি।
১৯৯১ সালে হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.) পুনরায় ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু করতে সক্ষম হলেন। আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা (ইক্বরা) আয়োজিত বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৫ নভেম্বর, ঢাকার পল্টন ময়দানে।উক্ত সম্মেলন উদ্ভোধন করেন বাংলাদেশের তংকালীন রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাস।
১৯৯১ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১৪ বছর আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। ২০০৪ সালের পর দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম স্থগিত ছিল। ২০১২ সালে ১৫তম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনের মাধ্যমে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় ‘ইক্বরা’ আয়োজিত উক্ত সম্মেলনটি বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনে পরিণত হয়েছে। ‘ইক্বরা’ কুরআন তিলাওয়াতের এই সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত সংস্থা (ইক্বরা) বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত প্রচার, শিক্ষা প্রদান ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধনপ্রাপ্ত একটি সেবামূলক অলাভজনক সংস্থা। এ সংস্থার অধীনে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও একমাত্র স্বতন্ত্র ইলমে ক্বিরাতের প্রতিষ্ঠান “মা’হাদুল ক্বিরাত বাংলাদেশ” পরিচালিত হচ্ছে যেখানে এদেশের প্রায় সকল ক্বারীগণ, হাফেযগণ, অসংখ্য উলামায়ে কেরাম, খতীব/ইমাম/শিক্ষকগণ, সমাজের সকল স্তরের সকল পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গ বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতের প্রশিক্ষণ নিয়ে সুনামের সাথে কাজ করছেন।
‘ইক্বরা’ একইসাথে মানবতার সেবায়ও কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে নির্যাতিত, নিপীড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সেবায় ৫০১টি রোহিঙ্গা পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের খাদ্য সামগ্রী, আর্থিক অনুদান, মসজিদ নির্মাণ, ইমাম সাহেবের সম্মানী, পানির টিঊবয়েল, শৌচাগার, ঔষধ সামগ্রী, কুরআন মাজীদ ও কুরআন শিক্ষা বইসহ আনুষঙ্গিক সমস্ত প্রয়োজনের ব্যবস্থা করে ইক্বরা টীম এ কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকে। এছাড়া ইক্বরা’র মানব সেবা ফান্ড হতে বিভিন্ন সময় চিকিৎসায় আর্থিক অনুদান, অসামর্থ্যবানদের বিবাহে সহযোগিতা, বিভিন্ন মাদরাসায় ইয়াতীমদের খাদ্যের জন্য গবাদিপশু প্রদান করে পাশে দাঁড়িয়েছে।