কার্যনির্বাহী কমিটি

ইমামুল কুররা, মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহ.)

প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি

স্বাধীন সার্বভৌম লাল সবুজের অপূর্ব সুন্দর একটি দেশের নাম বাংলাদেশ, আর এই ব-দ্বীপে এসেছেন অসংখ্য আল্লাহর ওলী এবং দ্বীন এর বড় বড় খাদেম যারা এই জাতির জন্য বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন। আর তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন একসময়ের এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্বারীদের অন্যতম, উপমহাদেশের ইলমে ক্বিরাত জগতের কিংবদন্তী, বাংলাদেশের বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত ও ক্বিরাতের পথপ্রদর্শক,বীর মুক্তিযোদ্ধা ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ)।

জন্মঃ ১৫ জানুয়ারি, আনুমানিক ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার (বর্তমানে কর্ণফুলী) দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম আব্দুল খালেক্ব। মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন।

শিক্ষা জীবনঃ ৫ বছর বয়সে তিনি পটিয়ার মাওলানা খায়ের আহমাদ (রহঃ) এর কাছে কুরআনের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা শুরু করেন। ৭ বছর বয়সে পটিয়ায় অবস্থিত শাহিপুর মাদ্রাসায় কুরআন হিফয করা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ঐতিহ্যবাহী জিরি মাদ্রাসায় হিফয সমাপ্ত করে উক্ত প্রতিষ্ঠানেই হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৯৫৭ সালে দাওরা-এ-হাদিস সম্পন্ন করেন। ঘটনাক্রমে একদিন আসরের নামাজের সময় তাঁর আযান শুনে কণ্ঠস্বরের প্রশংসা করে জিরি মাদ্রাসার মুহাদ্দিস শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সন্দিপী (রহঃ) এবং জিরি মাদ্রাসার তৎকালীন মুহতামিম হযরত মাওলানা আহমাদ হুসাইন (রহঃ) তাঁকে ইলমে ক্বিরাতের উপর পড়াশুনা করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেন।

পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি যান। সেখানে তিনি পাকিস্তানের প্রখ্যাত ক্বারী যাহের ক্বাসেমী (রহঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দারুল কুরআন কাসেমিয়া লাজভেলা, করাচি’ তে ভর্তি হন। ক্বারী যাহের ক্বাসেমী (রহঃ) দারুল উলূম দেওবন্দ এর দীর্ঘ সময়ের মুহতামিম মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহঃ) এর ভাতিজা ছিলেন।

সেখানে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) ‘ইলমে ক্বিরাতের’ উপর কঠিন অধ্যবসায় শুরু করেন। তার ক্বিরাতের উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ইয়েমেনের বিখ্যাত ক্বারী উস্তাদ আলী মুহাম্মাদ শরফুদ্দীন (রহঃ), উপমহাদেশের প্রখ্যাত ক্বিরাতের উস্তাদ আফগানিস্তানের হাবিবুল্লাহ খাঁন (রহঃ), পাকিস্তানের ক্বারী মুহাম্মাদ ইলিয়াস (রহঃ)। দীর্ঘ ৫/৬ বছর ইলমে ক্বিরাতের উপর পড়াশুনা করে ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম বাঙালি হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সঃ) হতে ধারাবাহিকভাবে ক্বিরাতের সনদ (রেওয়ায়েত এ-হাফস) লাভ করেন।

কর্মজীবন,সফর ও অর্জনঃ

  • চট্টগ্রামে দাওরা-এ-হাদিস সম্পন্ন করার পর তিনি মাওলানা মেহেরুজ্জামান (রহঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাঙ্গুনিয়া মাদ্রাসায় ৩ মাস শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
  • পশ্চিম পাকিস্তানে ক্বিরাতের পড়াশুনা করা অবস্থাতেই তিনি করাচির গুলিমাগ এ ইমাম হিসেবে ১ বছর কর্মরত ছিলেন এবং ‘মাদরাসা তা’লিমুল কুরআন’ এ শিক্ষক হিসেবে বছরখানেক কর্মরত ছিলেন।
  • পড়াশুনার শেষ দিকে ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৬০ সালে তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে পাকিস্তান (করাচি) বেতারে প্রথম ও একমাত্র বাঙালি ক্বারী হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) চালু হওয়ার পর সেখানেও যোগদান করেন।
  • ১৯৬২ সালে তিনি করাচির আরামবাগ জামে মাসজিদ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত ‘অল পাকিস্তান ক্বিরাত কম্পিটিশন’ এ অংশগ্রহন করেন। যার আয়োজন করেছিলেন ক্বারী যাহের ক্বাসেমী (রহঃ)। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দ এর মুহতামিম হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহঃ)। বিচারক হিসেবে ছিলেন ইয়েমেনের উস্তাদ ক্বারী আলী মুহাম্মাদ শরফুদ্দীন (রহঃ), আফগানিস্তানের উস্তাদ হাবিবুল্লাহ খাঁন (রহঃ), উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ), মাওলানা মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁন (রহঃ), ক্বারী খলিলুর রহমান (রহঃ) এবং বায়তুল মোকাররমের মাওলানা আব্দুর রহমান বেখুত (রহঃ)। উক্ত প্রতিযোগিতায় ১ম হন মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহঃ) এর ভাতিজা এবং ক্বারী যাহের ক্বাসেমী (রহঃ) এর ছোট ভাই ক্বারী শাকের ক্বাসেমী এবং ২য় হন ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ)। প্রতিযোগিতা শেষে হযরত মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহঃ) ২ জনকে রৌপ্য পদক প্রদান করেন এবং সেখানেই মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহঃ), ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) কে নিজ হাতে ক্বিরাতের সনদ প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে উক্ত কম্পিটিশন এ ১২ জন অংশগ্রহন করেছিলেন
  • ১৯৬৩ সালে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে মালয়েশিয়া কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ‘৩য় আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহন করেন এবং দক্ষিন এশিয়ার সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে উক্ত ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়’ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক অর্জন করেন (কম্পিটিশন এর তখনকার নিয়মানুযায়ী ১ম ও ২য় প্রতিযোগি উভয়কেই স্বর্ণপদক দেয়া হতো। উক্ত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন মালয়েশিয়ার ক্বারী ইসমাইল বিন হাশিম) তাঁর এই পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সামনে পাকিস্তানের নামকে উজ্জ্বল করেন যার ফলে পাকিস্তানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংবাদ মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংবাদ প্রকাশ করা হয়। যার বেশীরভাগেরই মূল শিরোনাম ছিলো ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহাব নে পাকিস্তান কা নাম রশান কিয়া (অর্থাৎ ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেব বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের নাম উজ্জ্বল করেছেন)’। তখন মালয়েশিয়ার কম্পিটিশন এর সভাপতি ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্বারী শাইখ মুস্তাফা ইসমাঈল (রহঃ)।
  • ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বার্মার (মায়ানমার) রেঙ্গুনের সবচেয়ে বড় মাসজিদ সুরুতী মাসজিদের আন্তর্জাতিক মাহফিলে অংশগ্রহন করেন। তার সাথে ছিলেন লাহোরের ক্বারী গুলাম রসুল (রহঃ)। মাহফিল শেষ করে তিনি জানতে পারেন ‘মার্শাল ল’ জাড়ি করা হয়েছে। পরদিন জরুরি ভিত্তিতে রেঙ্গুনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হাবিবুর রহমান সাহেব তাদের পাকিস্তানের ফ্লাইটে উঠিয়ে দেন।
  • উক্ত বছরই তিনি সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক মাহফিলে’ অংশগ্রহন করেন।
  • ১৯৬৪ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়া বান্দুং এ অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ইসলামিক সম্মেলনে’ অংশগ্রহন করেন। যেখানে বিশ্বের ১০টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিগন অংশ নেন।
  • এছারাও হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে ৬০’র দশকে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনআরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন/সেমিনারে অতিথি হিসেবে অসংখ্যবার সফর করেন।
  • ১৯৬৬ সালে ক্বারী যাহের ক্বাসেমী, ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ এবং ক্বারী শাকের ক্বাসেমী ইসলামাবাদের ‘প্রেসিডেন্ট হাউসে’ গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান এর কাছে বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন করার ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন। তাঁরই সহযোগিতায় ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে বিশ্বের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ক্বারীদের সংগঠন (ইত্তেহাদুল কুররা আল আলামিয়া)International Quran Recitation Association(IQRA)গঠিত হয় যার সভাপতি মনোনীত হন মিসরের তৎকালীন শাইখুল কুররা, বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী শাইখ মাহমূদ খলিল আল-হুসারী এবং মহাসচিব হন পাকিস্তানের ক্বারী যাহের ক্বাসেমী। কার্যকরী সদস্য হিসেবে মনোনীত হন মিসরের বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী শাইখ আব্দুল বাসিত, তৎকালীন পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ, ইয়েমেনের শাইখ আলী মুহাম্মাদ শরফুদ্দিন, পাকিস্তানের ক্বারী মুহাম্মাদ ইলিয়াস, ক্বারী শাকের ক্বাসেমী এবং মাওলানা আসিফ ক্বাসেমী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালে ‘ইক্বরা’ আয়োজিত বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির নিশতার পার্ক, লাহোরের শাহী মাসজিদ এবং পেশাওয়ার-এ।
  • ১৯৬৭ সালে ‘ইক্বরা’ আয়োজিত ‘২য় আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা, সিলেটের আলিয়া মাদরাসা ময়দান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, পেশাওয়ার-এ। উক্ত সম্মেলন উদ্বোধন করেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ মুসা এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান। এতে শাইখ মুস্তাফা ইসমাঈল, শাইখ মাহমূদ খলিল আল হুসারী, শাইখ আব্দুল বাসিত, ক্বারী যাহের ক্বাসেমী, ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সহ ‘ইক্বরা’ এর সকল সদস্যগন সর্ব মোট বিশ্বের ১৭টি দেশের প্রখ্যাত ও বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী সাহেবগণ অংশ নেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমেই মূলত উপমহাদেশে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ও ইলমে ক্বিরাত শিক্ষা নেওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে ‘ইক্বরা’ এর পরবর্তী সম্মেলনগুলো স্থগিত হয়ে যায়।
  • ১৯৬৭ সালে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে মালয়েশিয়া কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহন করেন এবং ৩য় স্থান অর্জন করেন।
  • মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের এত বড় একজন বিখ্যাত ক্বারী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে কটাক্ষ করে ‘বাঙালি বাবু’ সম্বোধন শুনতে হতো যার ফলে তার মনের মধ্যে পাকিস্তানিদের প্রতি ধীরে ধীরে ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্বপক্ষে নিজেকে যুক্ত করেন। যার ফলে তিনি করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে(বাংলাদেশে) বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২-এর বাড়িতে এসে বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে সমাবেশ করার অনুরোধ জানান এবং রাজি করান। ফলে সে বছরই লাহোরে ৬-দফা দাবির আন্দোলন করা হয় এবং করাচির নিশতার পার্ক ময়দানে সমাবেশের আয়োজন করা হয় যেখানে লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয় এবং সেই সমাবেশে হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ ৬-দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ৬-ভরি স্বর্ণের পদক প্রদান করেন।
  • হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) ১৯৭১ সালে সংগঠিত মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলে পরদিন ২৬ মার্চ করাচি রেডিওর আঞ্চলিক পরিচালক তাহের শাহ (পাঞ্জাবী) হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ)কে ডেকে পাঠালেন। তিনি যাওয়ার পর তাহের শাহ রেডিও ও টিভির সব অফিসারদেরকে ডাকলেন। সবার সামনে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) কে অপমানের সাথে করাচি রেডিও ও পিটিভি থেকে চাকুরীচ্যুত করে। হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ তৎকালীন এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠ ক্বারীদের অন্যতম ছিলেন এবং পাকিস্তানের এত বড় একজন বিখ্যাত ক্বারী হওয়া সত্ত্বেও, পাকিস্তানের জন্য এত সম্মান বয়ে আনার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করায় তাঁর কর্মস্থল থেকে বহিষ্কৃত হন। করাচিতে তাঁর বাসস্থানে অসংখ্যবার হামলা করা হয় এবং এক পর্যায়ে তাঁর ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় তার উপর পাকিস্তানি সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং তিনি কিছুদিন তার কিছু ভক্ত এবং ছাত্রদের সহযোগিতায় লুকিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের অফিসার তাঁর এক ছাত্রের (মাযহার সাহেব) সহযোগিতায় নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান থেকে সবকিছু (বাসস্থান,অর্থসম্পদ,সম্পত্তি) ত্যাগ করে সর্বশেষ ফ্লাইটে শ্রীলঙ্কাতে গিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশে (ঢাকার তেজগাঁও এয়ারপোর্টে) প্রত্যাবর্তন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন।
  • যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই পাকিস্তান বেতারের (ঢাকা অঞ্চল) মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান তাঁকে নতুন করে ঢাকা বেতারে প্রোগ্রাম শুরু করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন ‘যত দিন পাকিস্তানের পতাকা থাকবে ততদিন আমি কোন অনুষ্ঠান করবনা’।
  • হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুযুর (রহঃ) এবং মাওলানা মুফতি দীন মুহাম্মাদ খান (রহঃ), তারা উভয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রতিটি ঘরে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ পৌঁছানোর মাধ্যমে এর শিক্ষা দেওয়া। হযরত হাফেজ্জি হুযুর (রহঃ) এবং মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খান (রহঃ) উভয়েই তাঁদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে যখনই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এশিয়া মহাদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ ক্বারী হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ হতো তারা উভয়ই তখন অনুরোধ করতেন যেন ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে এসে বিশুদ্ধ তিলাওয়াত ও ক্বিরাতের তা’লিম শুরু করেন। কিন্তু পিটিভি ও করাচি রেডিওর অর্পিত দায়িত্ব এবং তৎকালীন বিশ্বের প্রসিদ্ধ ক্বারীদের সংগঠন IQRA -এর প্রতিষ্ঠাতা কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারনে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আসতে পারেননি।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই সেপ্টেম্বর মাসেই হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুযুর (রহঃ), মুফতি দ্বীন মুহাম্মাদ খাঁন(রহঃ), উর্দুরোড জামে মাসজিদের ইমাম ও বড় কাঁটারা মাদরাসার উস্তাদ হাফেয মাওলানা মীর আহমাদ (রহঃ) এবং হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) এর উদ্যোগে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও একমাত্র স্বতন্ত্র বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত ও ইলমে ক্বিরাত এর প্রতিষ্ঠান ‘মাদ্রাসা দারুল কুরআন’ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকার উর্দু রোড জামে মাসজিদে। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহঃ) এবং জাতীয় মাসজিদের খতীব আল্লামা ওবায়দুল হক (রহঃ) এর দু’আর মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে মা’হাদুল ক্বিরাত বাংলাদেশ রাখা হয়। হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুযুর (রহঃ) এর একটি স্বপ্ন ছিল যে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে হবে একটি করে মক্তব। সেই লক্ষেই তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এই দায়িত্ব হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) কে দিয়ে যান।

  • ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে হযরত ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) এর সাক্ষাত হলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর বাসায় যেতে বলেন। পরে তার বাসায় গেলে বঙ্গবন্ধু বললেন “মাওলানা আপনি আবার আমার সাথে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকুন এবং পরবর্তীতে আপনার এলাকা চট্টগ্রাম থেকে ইলেকশন করবেন”। তখন হযরত ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) সবিনয়ে সেই প্রস্তাব গ্রহন না করে বললেন “মুজিব ভাই আমি আর রাজনীতি করতে চাইনা, বাকি সারা জীবন কুরআনের খিদমত করতে চাই”। পরবর্তী সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু বললেন “তাহলে আপনার জন্য তিনটি সরকারি পদ আছে- ১। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের প্রধান ক্বারী, ২। জাতীয় মাসজিদ বায়তুল মোকাররম এর খতীব, এবং ৩। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রধান ক্বারী।

তখন ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) বললেন “যেহেতু আমি আগেও পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে কাজ করেছি সুতরাং বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে কুরআনের খেদমত করতে চাই”। তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে সরকারিভাবে বাংলাদেশের প্রধান ক্বারি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন যার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের পাশাপাশি সমস্ত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তিলাওয়াত করা। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম ক্বারী যার তিলাওয়াতের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে তিলাওয়াত শুরু হয় এবং তাঁর যোগদানের পর বাংলার মানুষ শুনতে পেল এক ব্যতিক্রমধর্মী সুমধুর কণ্ঠের কুরআন তিলাওয়াত যেরকম তিলাওয়াত কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্যেই শোনা যেত এবং এই তিলাওয়াত শুনেই সারা বাংলার অসংখ্য মানুষ কুরআন কে ভালবেসে নিজের সন্তানকে হাফিযে কুরআন ও আলেম বানান। স্বাধীনতার পর একটানা ৩ বছর তিনি একাই বাংলাদেশ বেতার ও টিভিতে সমস্ত অনুষ্ঠানে তিলাওয়াত করেছেন।

  • ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে উদ্বুদ্ধ করাঃ ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর করেন। ১৯৬৩ সালে মায়ানমার সফরে তিনি রেঙ্গুনের সুরুতী মাসজিদ প্রাঙ্গনে একটি ইসলামিক সেন্টার দেখলেন। মালয়েশিয়ার ‘জাতীয় মাসজিদ নাগারা’ প্রাঙ্গনেও এরূপ একটি ইসলামিক সেন্টার দেখলেন। ইন্দোনেশিয়াতেও একি রকম বড় ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেখলেন। তখন তিনি এরুপ একটি বৃহৎ ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) হওয়ার উপলব্ধি করলেন। তখন কেবল একটি ছোট ইসলামিক একাডেমি ভবন ছিল। স্বাধীনতার পূর্বেই বিভিন্নবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে একটি ইসলামিক সেন্টার এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ওয়াদা করলেন এবং বললেন আপনারা দুআ করুন, বাংলাদেশ হওয়ার পর ইনশাল্লাহ আমি করব

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় ইসলামিক সেন্টার এর কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) কে বললেন “আপনারা মিটিং করুন এবং পরামর্শ করুন এই বিষয়ে”।

১ম মিটিং অনুষ্ঠিত হলো বায়তুল মোকাররমের ইসলামিক একাডেমির বিল্ডিং এ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন- হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ, মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মাওলানা খাইরুল ইসলাম যশোরী, কুমিল্লার মাওলানা হাবিবুর রহমান, ইসলামিক একাডেমির ডিজি চট্টগ্রামের আহমাদ হুসাইন, ইসলামিক একাডেমির আব্দুল কুদ্দুস এবং মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদি। উক্ত মিটিংসমুহে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবিত হলো “ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ” এর নাম এবং এর কিছু কার্যবিবরন। কমিটির এই প্রস্তাবিত কাগজপত্র বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে তিনি উক্ত প্রস্তাবসমূহকে গ্রহন করে একটি ইসলামিক একাডেমি থেকে পূর্ণাঙ্গ ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৫ সালে।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ইন্তেকালের পর স্বাধীনতা বিরোধীশক্তির কিছু মানুষ এই ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইমামুল কুররা মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) সহ যাদের অবদান ছিল তাঁর সমস্ত ফাইল ও মিটিং এর নথিপত্র গায়েব করে ফেলে।

  • ১৯৭৫ সালে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে মালয়েশিয়া কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়” অংশগ্রহন করেন এবং চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। উক্ত প্রতিযোগিতায় ক্বারী উবায়দুল্লাহ (রহঃ) ও অংশ নেন। এবং উক্ত সফর শেষে উভয়েই সিঙ্গাপুর এর মাহফিলে অংশগ্রহন করেন।
  • ১৯৭৮ সালে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে মালয়েশিয়া ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়’ অংশগ্রহন করেন এবং ৩য় স্থান অর্জন করেন।
  • ১৯৭৯ সালে তিনি সৌদি আরবের বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আযিয আল- সৌদ এর রাজকীয় অতিথি হিসেবে আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স এ অংশগ্রহন করেন। সাথে ক্বারী উবায়দুল্লাহ (রহঃ) ও ছিলেন। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের সম্মানিত স্কলারগণ, মন্ত্রী, স্পিকার, রাষ্ট্রদূতগণ, ক্বারীগণ অংশগ্রহন করেন এবং সকলেই বাদশার রাজকীয় প্রাসাদে বাদশাহ এর দাওয়াতে অংশ নেন। উক্ত কনফারেন্সে ইমামুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) ও ক্বারী উবায়দুল্লাহ (রহঃ) তিলাওয়াত করেন যা সমগ্র আরববিশ্বে প্রচার করা হয়। তিলাওয়াত শেষে সৌদি বাদশার পক্ষ থেকে উনাদের স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। তখন সৌদিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন জনাব হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী (পরবর্তীতে সংসদের স্পিকার)। কনফারেন্স এর পর তিনি অত্যন্ত খুশি হয়ে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবকে বললেন “আমি যা চেয়েছিলাম তাই হয়েছে, আপনাদের তিলাওয়াত শুনে অনেক ফোন এসেছে আমার কাছে, বাংলাদেশে এত উচ্চমানের ক্বারী আছে যার প্রশংসা করছে সবাই এবং আপনাদের তিলাওয়াত শুনে অনেকেই বলছে বাংলাদেশ তাহলে মুসলিম দেশ”। (উল্লেখ্য স্বাধীনতাবিরোধী কিছু চক্র বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের কাছে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করত)

তারপর একদিন আনুমানিক রাত ১২.৩০ এর সময় ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ), মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট এর স্পিকার তুন দাঁতো সাইয়েদ নাসের ইসমাইল, ক্বারী উবায়দুল্লাহ (রহঃ) এবং বিভিন্ন দেশের কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিদের আল্লাহর ঘর খানা-এ-ক্বাবা এ প্রবেশ করানো হয়। ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) ৪৫ মিনিট খানা-এ-ক্বাবা তে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি রুকনে ইয়ামানি এর সামনে ৪রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন।

পরবর্তীতে বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আযিয আল-সৌদ সকল মেহমানদের সম্মানে ভোজের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি নিজ হাতে ইমামুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) সহ রাষ্ট্রীয় অতিথিদের ক্বা’বা শরিফের গিলাফ (ক্বিসওয়াহ) উপহার দেন।

জাতীয় ক্বিরাত ও আযান প্রতিযোগিতার সচনাঃ

জিয়াউর রহমান সাহেব রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় বঙ্গভবনের দরবার হলে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানির সহধর্মিণীকে পদক দিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) তিলাওয়াত করলেন। অনুষ্ঠান শেষে জিয়াউর রহমান সাহেব দরবার হল থেকে বের হওয়ার সময় ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবের হাত ধরে উনার লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে বসার পর রাষ্ট্রপতি ২ বার বললেন “আপনি কিছু বলেন না কেন?”, জবাবে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেব বললেন “আমি বলব?”, রাষ্ট্রপতি বললেন “বলুন”। তখন ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) বললেন “আপনি বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনের আয়োজন করুন”। জিয়াউর রহমান সাহেব বললেন “ঠিক আছে, প্রথমে জাতীয়ভাবে সম্মেলন হোক, তারপর আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজন করবো”। তখন তিনি ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবের সামনে ধর্মমন্ত্রীকে ফোন করলেন এবং বললেন “আপনি একটি ক্বিরাত সম্মেলন আয়োজনের ব্যবস্থা করুন”। পরবর্তীতে এর আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গভবনের দরবার হলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় ক্বিরাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো যার প্রধান বিচারক ছিলেন ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ)। অনুষ্ঠান চলাকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেব ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবকে বললেন “আপনি বাংলাদেশের নক্ষত্র, আপনি আমার পাশেই বসুন”। তখন তিনি ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবকে মাঝখানে বসালেন, তার ডানপাশে বসলেন জিয়াউর রহমান সাহেব এবং বামপাশে বসলেন আব্দুস সাত্তার সাহেব (পরবর্তী রাষ্ট্রপতি)। এর পর থেকেই বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর অধীনে ক্বিরাত, আযান ও ইসলামি সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলো।

পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সাহেবের ইন্তেকাল হলো এবং আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনের আয়োজনের বিষয়টি থেমে গেল।

সেনাবাহিনী,বিমানবাহিনী,নৌবাহিনীর ক্বিরাত ও আযান প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার সূচনাঃ

জেনারেল হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় তার সাথে ইমামুল কুররা হযরত ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) এর একটি প্রোগ্রাম ছিল। অনুষ্ঠান শেষে চা-পর্বে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) এরশাদ সাহেবকে বললেন “১৯৬২ সালে মিশর সেনাবাহিনীর একটি দল পাকিস্তান সফরে এসেছিল, সেই সফরে তাঁদের বেশকয়েকজন অনেক ভালমানের ক্বারীও ছিল”। তখন তিনি এরশাদ সাহেবকে প্রস্তাব করলেন “আমাদের সেনাবাহিনীর ছেলেদের জন্য কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিন”। তখন সেখানে এরশাদ সাহেব ও ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবের সামনে ছিলেন মুহাম্মাদ ফারুক খান সাহেব (পরবর্তীতে লেঃ কর্নেল ও মন্ত্রী) এরশাদ সাহেব তাঁকে বললেন “আমার বাহিনীর এই ছেলেদের আগামী বছর থেকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কম্পিটিশন এর ব্যবস্থা করো”।

পরবর্তী বছর থেকে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) এর প্রস্তাব অনুযায়ী উনার অধীনে প্রথমে সেনাবাহিনী এবং পরবর্তীতে বিমানবাহিনীকে কুরআন তিলাওয়াতের শিক্ষা ও তাঁদের মধ্যকার কম্পিটিশন শুরু হলো যা এখনো চলছে।

  • ১৯৮৩ সালে শাইখুল কুররা হযরত ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ হাফিযাহুল্লহ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে মালয়েশিয়া কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত “আন্তর্জাতিক ক্বিরাত প্রতিযোগিতায়” অংশগ্রহন করেন এবং চতুর্থ স্থান অর্জন করেন।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন আয়োজনের পুনরায় প্রচেষ্টাঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) বাংলাদেশে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রমকে পুনরায় শুরু করার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। কিন্তু নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত একটি  দেশে সম্পদের স্বল্পতা এবং দেশজ উন্নয়নের কারণে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুরু করা যায়নি।

১৯৯০ সালে হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ সাহেবের এর ক্ষমতার শেষ দিকে ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেব একটি ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনের’ তারিখ ঠিক করে এরশাদ সাহেবের সাথে সাক্ষাত করলেন। তিনি এরশাদ সাহেবকে উক্ত সম্মেলনের প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত করলেন। এরশাদ সাহেব দাওয়াত গ্রহন করে বললেন তিনি উক্ত সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকার প্রত্যেকটি প্রবেশমুখে একটি করে তোরণ করে দিবেন, সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)কে বলে দিবেন, এবং তিনি উক্ত সম্মেলন আয়োজনের জন্য ১০লক্ষ্য টাকা অনুদান দিবেন বলে ওয়াদা করলেন

পরবর্তীতে আন্দোলনের কারনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে সম্মেলনের বিষয়টি স্থগিত হয়ে যাচ্ছিল। তখন এরশাদ সাহেবের ক্যাবিনেট এর মন্ত্রী দৈনিক ইনকিলাব এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল মান্নান সাহেব ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবকে বললেন ‘আপনি একটু ধৈর্য ধরুন, সম্মেলন হবে”। কিন্তু ২দিন পর তিনি পদত্যাগ করলেন। তারপর আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন আয়োজনের বিষয়টি বাতিল হয়ে গেল।

  • ১৯৯১ সালে ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ সাহেবের একক প্রচেষ্টায় পুনরায় ‘International Quran Recitation Association(IQRA) এর কার্যক্রম বাংলাদেশে শুরু করতে সক্ষম হলেন।‘ইক্বরা’ আয়োজিত বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। উক্ত সম্মেলন উদ্ভোধন করেন বাংলাদেশের তংকালীন রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাস। ১৯৯১ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১৪ বছর তিনি ‘আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলন’ আয়োজন করেছেন ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। ২০০৪ সালের পর দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম স্থগিত ছিল। ২০১২ সালে ১৫তম আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সম্মেলনের মাধ্যমে ইমামুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) পুনরায় ‘ইক্বরা’র কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছেন। উক্ত সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে ইমামুল কুররা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শেখার প্রতি ব্যাপক আগ্রহী করে তুলেছেন।
  • ১৯৯৬ সালের ২৫মার্চ ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ইসলামী বিদ্যাপীঠ “দারুল উলূম দেওবন্দ”এর মুহতামিম হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান সাহেব (রহঃ) এর দাওয়াতে ভারত সফর করেন এবং তাঁকে দারুল উলূম দেওবন্দ এর ‘দারুল হাদিসে’ সংবর্ধনা প্রদান করেন। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন ‘ওয়াকফ দারুল উলূম’এর মুহতামিম হযরত মাওলানা সালেম ক্বাসেমী (রহঃ) [মাওলানা ক্বারী তৈয়ব সাহেব (রহঃ) এর বড় সাহেবজাদা এবং ক্বারী যাহের কাসেমি (রহঃ) এর চাচাতো ভাই], মাওলানা আরশাদ মাদানি প্রমুখ। পরে হযরত মাওলানা সালেম ক্বাসেমী (রহঃ), হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) কে হাত ধরে পুরো দারুল উলূম দেওবন্দ ঘুরিয়ে দেখান।
  • ২০০১ সালে হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) কেনিয়া সফর করেন এবং সেখানকার রেডিও ও টেলিভিশন উনার তিলাওয়াত রেকর্ড করে।

ইমামুল কুররা হযরত মাওলানা ক্বারী মুহাম্মাদ ইউসুফ (রহঃ) বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মা’হাদুল ক্বিরাত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের সমস্ত ক্বারীগণ, এই দেশের বহু প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম, বিভিন্ন মাসজিদের খতীব/ইমাম/,মুআযযিন, বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকগণ সহ সকল পেশার সর্বসাধারণ তার কাছ থেকে বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত ও ক্বিরাতের তা’লীম নিয়েছেন। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এর অশেষ রহমতে তার অক্লান্ত পরিশ্রমে এদেশে পরিপূর্ণভাবে ক্বিরাত এর ময়দান তৈরি হয়েছে যেখানে এদেশের সমস্ত উল্লেখযোগ্য ক্বারীগণ উনার দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছেন। দীর্ঘ এত বছরের প্রচেষ্টায় তিনি লক্ষাধিক মানুষকে কুরআন শিখিয়েছেন।

  • ইন্তেকালঃ কুরআনের এই মহান সাধক দীর্ঘ কয়েক বছর বার্ধক্যজনিত কারনে অসুস্থ ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল, ১ শা’বান ১৪৩৯ হিজরি ইন্তেকাল করেন। তাকে তার জন্মস্থান কর্ণফুলী থানার দৌলতপুর গ্রামে মায়ের পাশে দাফন করা হয়।

শাইখ ক্বারী আহমাদ বিন ইউসুফ আল-আযহারী

সভাপতি

সাখাওয়াত খান

মহাসচিব

শাইখ ক্বারী ডাঃ আহমাদ আহমাদ নাইনা(মিশর)

আন্তর্জাতিক মহাসচিব (২০১৬- )

খালেদ বিন ইউসুফ

যুগ্ন-মহাসচিব

হারেস বিন ইউসুফ

যুগ্ন-মহাসচিব

মারহুম ক্বারী ডঃ সুলাইমান বিন ইবরাহীম আল বারুহী(মালয়েশিয়া)

সাবেক আন্তর্জাতিক মহাসচিব(২০০১-২০১৪)

"خيركم من تعلم القرآن وعلمه"-'The best amongst you are the ones who learn Quran and teach it to others'